টাঙ্গাইল জেলার ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে (জিআই ) স্বীকৃতি পেল মধুপুরের সুস্বাদু ও রসালো আনারস। মধুপুর গড় অঞ্চলে উৎপাদিত আনারস স্বীকৃতি পাওয়ায় সর্বত্র আনন্দের বাতাস বইছে। এতে ফলটির চাষে গুণগত পরিবর্তন এবং বিদেশে রপ্তানির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
মধুপুর গড়াঞ্চলের অন্যতম অর্থকরি ফসল এই আনারসের এমন স্বীকৃতি বহু প্রত্যাশিত আন্তর্জাতিক বাজার পাবে বলে অনেকে প্রত্যাশা করছেন। বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্র তৈরি করতে আনারস চাষে হতে হবে সতর্ক ও দায়িত্বশীল, এমন ইঙ্গিত করেছেন কেউ কেউ।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভৌগোলিক নির্দেশক ইউনিট ২৪ সেপ্টেম্বর মধুপুরের আনারসকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি সনদ দিয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্প-নকশা টের্ডমার্ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মুমিন হাসান স্বাক্ষরিত একটি পত্রে ৩১ শ্রেণিতে জিআই-৫২ নম্বরে মধুপুরের আনারসকে ভৌগোলিক নির্দেশক সনদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে ফলটির চাষে গুণগত পরিবর্তন এবং বিদেশে রপ্তানির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। মধুপুর অঞ্চলে আনারস চাষের গোড়ার ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা গেছে, ১৯৪২ সালে আনারস চাষ শুরু হয় উপজেলার ইদিলপুর গ্রামের নৃ-তাত্ত্বিক গারো সম্প্রদায়ের মিজি দয়াময়ী সাংমার হাত ধরে। পরিবার সূত্র জানায়, তিনি ভারতের মেঘালয়ের এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে আনারস চাষ ও আনারসের চারা দেখে আগ্রহ হয়। তাই তিনি দেশে ফিরেন বেশ কিছু আনারস চারা নিয়ে। বাড়ির আঙ্গিনায় শুরু করেন আনরস চাষ। সেই থেকে শুরু হয়ে আজ এ আনারস চাষ এলাকা ও দেশকে করেছে সমৃদ্ধ। মধুপুরের আনারসের নিজস্ব ঐতিহ্য রয়েছে। হানিকুইন জায়েন্টকিউ ও জলডুগি আনারসের মিষ্টতা আলাদা। স্বাদ ঘ্রাণও বেশি। মধুপুর গড়াঞ্চলে এখন ৭ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমিতে আনারস চাষ হয়।
কৃষিতে জাতীয় পদক পাওয়া সিআইপি কৃষক গারো বাজারের ছানোয়ার হোসেনের মতে, মধুপুরের আনারস চাষাবাদ বাজার জাতে যতটুকু এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল নানা কারণে আশানুরূপ হচ্ছিল না। ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় একটা আশার জায়গা তৈরি হলো। আন্তর্জাতিক বাজার ধরে বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে আনারস চাষে পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের আনারসের নতুন পরিচয় মধুপুরকেও অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলেও তার আশাবাদ।
মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাকুরা নাম্মী বলেন, জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া মানে ভৌগোলিক নির্দেশক। আনারস মধুপুর ছাড়াও সিলেট, পার্বত্য এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে জন্মে থাকে। এখন আনারস মানে দেশে এবং দেশের বাইরে মধুপুরের আনারস হিসেবে পরিচিতি পাবে।
মধুপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার জুবায়ের হোসেন বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে দেশের ঐতিহ্যবাহী পণ্যের জিআই স্বীকৃতি লাভ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মধুপুরের আনারসের জিআই জার্নালের জন্য অনুমোদিত হওয়াটা মধুপুরবাসীর জন্য অত্যন্ত আনন্দ ও গর্বের একটি ঘটনা।
স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত আনারসের জিআই স্বীকৃতি লাভ মধুপুরবাসীর জন্য অত্যন্ত আনন্দের ও গর্বের বিষয়। মধুপুর আনারস সারা দেশে জনপ্রিয়। এখন বিশ্ব এর সঙ্গে পরিচিত হলো। এতে বিশ্বে মধুপুর আনারসের বাজার তৈরি হবে।’
টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, টাঙ্গাইলের মধুপুর গড় অঞ্চলে বছরে কয়েকশ কোটি টাকার বিপুল পরিমাণ আনারস উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে জায়ান্ট কিউ বা স্থানীয়ভাবে ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত এ অঞ্চলের প্রধান জাত। বাকিগুলো হলো হানি কুইন যা স্থানীয়ভাবে জলডুঙ্গি নামে পরিচিত এবং এমডি -২ ও আশ্বিনা।
টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ – সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নার্গিস আক্তার বলেন, ‘এ বছর জেলায় ৭ হাজার ৭৭৩ হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে মধুপুর উপজেলায় ৬ হাজার ৬৩০ হেক্টর এবং ঘাটাইল উপজেলায় ১ হাজার ১৪০ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘গত বছর দুই উপজেলায় ৭ হাজার ৬৬১ হেক্টর জমিতে আনারস চাষ হয়েছে এবং ২ লাখ ৮২ হাজার টন আনারস উৎপাদিত হয়েছে।’
টাঙ্গাইলের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. কবির হোসেন বলেন, ‘মধুপুর ছাড়াও দেশের সিলেট ও পার্বত্য এলাকায় আনারসের চাষ হয়। তবে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার মানে হচ্ছে ভৌগোলিক নির্দেশ যুক্ত হওয়া। দেশে ও বিশ্ববাজারে এখন আনারস মানেই মধুপুরের আনারস। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে আনারস রপ্তানির সম্ভাবনা উন্মুক্ত হয়েছে।