মোজাম্মেল হক: শিশুর বেড়ে উঠার জন্য যে বিষয়টি সবচেয়ে জরুরি সেটি হচ্ছে খেলাধুলা। খেলাধুলা শিশু কিশোরদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। খেলাধুলা তরুণ এবং যুবসমাজকে সব খারাপ কাজ থেকে দূরে রাখে। মাদক, নেশা, মোবাইল, ইন্টারনেট, পর্নোগ্রাফি’সহ বর্তমান সময়ের কিছু তরুণ-তরুণীরা হেন কোনো নোংরা নেশা নেই যাতে আসক্ত হচ্ছে না।
অথচ এই খেলাধুলার মাধ্যমে এসব থেকে দূরে থাকতে পারত আজকের তরুণ ছেলেমেয়েরা। আজকের শিশু-কিশোরা খেলাধূলা করতে পারছে না এটা বোধহয় এখন সারা দেশের মানুষ জানে। কারন হারিয়ে যাচ্ছে শিশু কিশোরদের খেলার মাঠ। একসময় মানুষ বলতো খেলার মাঠ দিন দিন কমে যাচ্ছে। এখন বলা যায় খেলার মাঠ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
অথচ কয়েক দশক আগে শিশু কিশোর বয়সে বাড়ীর পাশে ফাঁকা মাঠটি ছিলো। শিশু কৈশোর বয়সে দৌড়ঝাঁপ দেওয়ার সেই মাঠগুলি এখন স্মৃতিময় অতীত। দিনে দিনে জনসংখ্যার বৃদ্ধির কারনে আশে পাশে গড়ে উঠছে বড় বড় দালান কোঠা। ইট-পাথরের দেওয়ালের ধাক্কায় খেলার ছোট্র জায়গাটুকু স্বাভাবিক নিয়মেই হারিয়ে যাচ্ছে। কোমলমতি শিশু কিশোর মাঠের অভাবে ঘরে বসে মোবাইল গেমসে আসক্ত হয়ে পড়ছে। মাঠে যখন একত্র হয়ে খেলাধুলা করতো, সেটা মোবাইল গেমসে ঘরে বসে একত্র হয়ে গেমস খেয়ে নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়ছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে বাড়ছে শিশুর সংখ্যা, কিন্তু মাঠের সংখ্যা বাড়ছে না, দিনে দিনে মাঠের সংখ্যা কমে আসছে। শিশরা দূরের কথা, এখন তরুণ ছেলেরাও খেলার জন্য মাঠ খুঁজে পায় না। মাঠ আছে শুধু জাতীয় পর্যায়ের খেলার জন্য। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে খেলার জন্য তৈরি হতে আগে তো ছোট মাঠে খেলতে হবে। ছোট ছোট খালি জায়গায় এখন ছেলেমেয়েরা ক্রিকেট ও ফুটবল খেলে। কিন্তু গ্রাম বাংলার আরো অনেক খেলা আছে, সেই খেলাগুলি খেলেনা। গোল্লাছুট, কানামাছি, লবনদাঁিড়, সাঁত চারা, লাটিমসহ অনেক খেলা এখন দেখাই যায় না। মাঠের অভাবে জনপ্রিয় হা ডু ডু, ভলিবলও হারিয়ে যাওয়ার পথে।
গ্রাম অঞ্চলের এই খেলাগুলি আয়োজন করলে প্রচুর দর্শক উপস্থিত হয়। কিন্তু এই খেলাগুলি এখন প্রয়োজন না পড়লে খেলে না। এ থেকে বুঝা যায় শিশু কিশোর ও তরুণদের ভেতর খেলাধুলার ইচ্ছা এবং আগ্রহ বর্তমান সময়ে হত্যা করা হচ্ছে। আমরাই এ জন্য দায়ী।
আমরা বসত বাড়ির জন্য ইট-পাথরের বড় বড় ইমারত গড়ছি, অথচ ভবিষ্যৎ শিশু কিশোরদের জন্য খেলাধুলার জন্য কোন মাঠ রাখছি না। তাদের হাতে বই তুলে দিয়ে বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছি আর পড়াশোনা চাপ দিচ্ছি। ওরাও পড়াশোনার বই পড়ে বাইরের জগৎ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। আর অবসর সময়ে বাবা, মা দেওয়া মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এভাবেই এ থেকে কিছু ছেলেমেয়ে তরুণ ও যুবক বয়সে ফেসবুক আসক্ত কিংবা মাদক নির্ভর হতে সময় লাগবে না।
টাঙ্গাইল শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে অনেক পরিত্যক্ত জায়গায় শিশু কিশোররা খেলাধূলা করতো। থানাপাড়ার রেঞ্জার মাঠ,ইস্টার্ন ক্লারের বাবুঁিচপাড়া মাঠ, সবুজ সেনা মাঠ। আদি টাঙ্গাইলে সাদ্দাম মাঠ, বাজিতপুর মাঠ, আকুরটাকুর পাড়া মির্জা মাঠ ও হাউজিং মাঠ, কলেজ পাড়া বালুর মাঠ, পানির টাংক মাঠ, ছোট কালিবাড়ীর শিমুলতলী মাঠ, কোদালিয়া মাঠ, শহরে নজরুল সেনা মাঠ, বেড়া বুচনা মাঠ, পাড়দিঘুলিয়া মাঠ, ভাল্লুককান্দি এয়ারপোর্ট মাঠ, বৈল্লা মাঠ, বাসাখানপুর মাঠ, জেলা পরিষদ মাঠ, কাগমারী ও পাতুলী পাড়সহ বিভিন্ন মাঠ হারিয়ে গেছে এবং কিছু হারিয়ে যাওয়ার পথে আছে।
পৌর এলাকার ১৩নং ওয়ার্ডে রেঞ্জার মাঠ, সবুজ সেনা মাঠ, থানাপাড়া ইস্টার্ন মাঠ(বাবুর্চিপাড়া) এখন নাই। সেখানে গড়ে ঘনবসতিপূর্ন দালানকোঠা ভরে গেছে। ২নং ওয়ার্ডে ঠাকুরবাড়ির মাঠটি মালিকানা দ্বন্দে¦ এলাকার শিশু-কিশোরদের এই মাঠে খেলাধূলা প্রায় বন্ধ। ৩নং ওয়ার্ডের মির্জা মাঠ ও হাউজিং মাঠে এক সময় এলাকার শিশু কিশোররা খেলাধূলা করতো। এছাড়া সকাল ও বিকেল স্বাস্থ্য সচেতন লোকজন শরীরচর্চা করতো।
বর্তমানে মাঠ দুটিতে মানুষেরর বসবাসের জন্য বসতি গড়ে উঠেছে। ৬ নং ওয়ার্ডেও কলেজ পাড়ার বালুর মাঠে গড়ে উঠেছে বড় বড় ইমারত। একই এলাকায় পানির ট্যাংকের মাঠে এখন আর শিশু-কিশোরদের প্রবেশ অধিকার নেই। ১৬ নং ওয়ার্ডে ছোট কালিবাড়ীর শিমুলতলী খেলার মাঠ ও কেওছার মাঠের অস্তিত্ব নেই। এছাড়া নজরুল সেনা মাঠের জায়গায় গড়ে উঠেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শহিদ স্মৃতি পৌরউদ্যান। ১৮নং ওয়ার্ডের কোদালিয়া মাঠ এখন টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজের একাডেমী ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ১২নং ওয়ার্ড আদিটাঙ্গালের বাজিতপুর মাঠটি অযত্ন অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অথচ এই মাঠে নব্বই দশকে প্রচুর খেলাধুলা হতো।
এখানকার কিশোর ও তরুণরা মাঠ না পেয়ে ছোট্র গলির ভিতর তারা ক্রিকেট ও ফুটবল খেলছে। বর্তমানে ছক্কা মারার মতো এলাকায় কোন মাঠ নেই। এখন জায়গায় জায়গায় শর্টপিচ নামক খেলাধূলা হয়। ক্রিকেটে শর্টপিস আর ফুটবলে মিনিবার। মিনিবার ফুটবল গোলকিপার বলতে কিছু নেই। সবাই পা দিয়ে বল লাথি দিবে। এভাবেই খেলার ধরন পালটে যাচ্ছে। কিছু তরুণ যুবকরা ব্যস্ততার দেখিয়ে প্রয়োজনীয় সম্পদ বিদ্যুতের অপচয় করে রাতের বেলা শর্টপিস ক্রিকেট কিংবা মিনিবারে ফুটবল খেলা আয়োজন করছে। এই খেলায় বিনোদন ছাড়া কোন কাজেই আসবে না।
ছেলেমেয়েদের খেলার মাঠ নেই, ওরা মাঠ না পেয়ে খেলাধুলা থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ছে। অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে আড্ডায় চক্করে। এসব আড্ডা থেকে অনেকেই মাদকের আড্ডায় যেতে পারে!। স্থানীয় প্রশাসনকে এই বিষয়ে নজর দিতে হবে। আমরা বলি’ খেলাধুলা বাড়ে বল, মাদক ছেড়ে খেলতে চল’ কিন্তু কোথায় যাবে সেটি কেউ আর ঠিক করে দেয় না।
ক্রীড়াপ্রেমী দর্শক দেলোয়ার হোসেন বলেন, মোবাইল আসক্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শিশু-কিশোরদের জন্য খেলাধুলার মাঠ দরকার। প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে খেলাধুলার মাঠের ব্যবস্থা রাখলে ভালো হবে।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে একজন প্রভাষক বলেন, মাদকের রাস্তা এখন একটা বাচ্চা ছেলেও চেনে। কিন্তু খেলার মাঠ এখন কেউ খুঁজলে পায় না। দেশের রাজনৈতিক কিছু নেতারা এই শিশু কিশোরদের খেলার জন্য মাঠে নয়, রাজনীতির মিছিলে নিয়ে অপরিনিত বয়সেই রাজনীতির আবহে প্রবেশ করিয়ে দেয়। রাজনীতি না বুঝেই রাজনীতিতে গিয়ে তার প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটাতে পারে না। তখন এদের মতো কিছু কিশোর “কিশোর গ্যাং” আড়ালে হারিয়ে যায়।
জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা মোঃ আফাজ উদ্দিন বলেন, দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ফাঁকা জায়গাগুলি বসতবাড়ী গড়ে উঠেছে। এ ব্যাপারে সরকারী উদ্যোগে মিনি স্টেডিয়াম তৈরী করছে। এছাড়া ইউনিয়ন পর্যায়ে উম্মুক্ত মাঠ করার বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করছেন। বাচ্চারা যেন মোবাইলে আসক্তি না হয় সে ব্যাপারে অভিভাবকদের সচেতন থাকতে হবে। অনেক অভিভাবক আছে যারা বাচ্চাদের মাঠে যেতে দেয় না, এটা ভুল। এছাড়া বাচ্চাদের খেলাধূলার জন্য বিভিন্ন প্রোগ্রাম আয়োজন করতে হবে। খেলাধূলা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো, এটা শিশু কিশোরদের বুঝাতে পারলেই সমস্যা দূর করা সম্ভব।
“স্বাস্থ্য সকল সুখের মূল” কথাটির সাথে একত্ব হলে স্বাস্থ্যর প্রতি যত্ন নিতে হবে। খেলাধুলা করতে হবে। খেলাধুলা করলে শরীর ভালো থাকে, শরীর ভালো থাকা মানেই মন ভালো থাকা। মন ভালো থাকলে সব ভালো কাজই সম্ভব।