নৃ-তাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী সংকট ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট” লেখক: কবি ও কলামিস্টমো. এনায়েত করিম।
বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সমঅধিকার থাকলেও কোটাআইনে নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর লোকেরা সাধারণ বাঙালির চেয়ে অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকে। মাত্র কয়েক শতাব্দী পূর্বে রিফিউজি হিসেবে আসলেও বর্তমানে তারা নিজেদের এতদ্বঞ্চলের ভূমিপুত্র বলে দাবি করছে। স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাচ্ছে দীর্ঘদিন যাবত। বাংলাদেশে বাস করে সব রকম নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে উল্টো দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান ধৃষ্টতা বৈ কিছু নয় । বিষয়টি বর্তমানে জাতীয় উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। এর নেপথ্যের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন নানা মহলের।
বাংলাদেশে প্রায় ৪৫ টির অধিক ক্ষুদ্র নৃ-জাতিগোষ্ঠীর বাস। এদের অধিকাংশই পার্বত্য-চট্টগ্রাম অঞ্চলের। দেশের অন্যান্য প্রান্তের উপজাতিরা দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলেও চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপজাতিরা বহুদিন ধরেই স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ভূখন্ডের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। দাবিকৃত অঞ্চল “জুমল্যান্ড নামে” নামকরণ করে নিজেদের পূর্ণ কর্তৃত্ব বহাল রাখতে স্বশস্ত্র অভিযানও পরিচালনা করছে। তাই এ অঞ্চলে ‘আদিবাসী’ প্রশ্নে বিতর্ক বহুদিনের।
আসলে ‘আদিবাসী’ কারা? তাদের পরিচয়ই বা কি?
আদিবাসী হলো সেই জনগোষ্ঠী যারা কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাস করছে এবং যাদের উৎপত্তি ও বসতি স্থাপনের কোনো সুনির্দিষ্ট ইতিহাস পাওয়া যায় না।
নৃতত্ত্ববিদ মর্গানের মতে, আদিবাসী জনগোষ্ঠী হচ্ছে ‘ভূমিপুত্র’, অর্থাৎ তারা একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে চিরকাল বাস করে এসেছে। কিন্তু ইতিহাস ও নৃতত্ত্বের গবেষণা অনুসারে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও পাহাড়িরা এদেশে বহিরাগত এবং তারা প্রাচীনকাল থেকে এখানে বসবাস করে না। তাদের বসতি স্থাপন মাত্র কয়েক শতাব্দী পূর্বের এবং তাদের আবাসস্থল ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং মিয়ানমারের পার্বত্য অঞ্চল থেকে আগত বলে প্রমাণিত হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও সংখ্যাগরিষ্ঠ হলো চাকমা। এরপরেই মারমা এবং ত্রিপুরা। নৃতত্ত্ববিদ টি. এইচ. লিউইন এর মতে চাকমা ও অন্যান্য পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর লোকেরা মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চল থেকে (১৭-১৮) শতকের শুরুতে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে । এই তথ্য অনুযায়ী, চাকমারা বাংলাদেশের আদি বাসিন্দা নয়। নৃতত্ত্ববিদ আর. এইচ. হুচিনসন, এন আহমেদ, অমরেন্দ্র লাল খিসার বিভিন্ন গবেষণায় উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, মিয়ানমার, এবং ত্রিপুরা অঞ্চল থেকে এসেছে । তাদের কোনো প্রাচীন ইতিহাস পাওয়া যায়নি যা প্রমাণ করে তারা হাজার বছর ধরে এদেশে বসবাস করছে। ভাষা ও সংস্কৃতির দিক থেকেও প্রমাণ মেলেনি তারা এ অঞ্চলের আদিবাসী। চাকমা এবং মারমা জনগোষ্ঠীর সাথে মিয়ানমারের ভাষা ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন রয়েছে। চাকমা ভাষা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার একটি গোত্র হিসেবে বিবেচিত, যা তাদের বাংলাদেশের মূল জাতিগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কিত করে না। মারমা ভাষা আরাকানি ভাষার একটি শাখা, যা তাদের মিয়ানমার অঞ্চলের বর্মি জাতিগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কিত করে ।
কাজেই নৃতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, এবং প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং পাহাড়ি জনগোষ্ঠী এদেশের আদিবাসী বা ভূমিপুত্র নয়। তাদের আগমন বহিরাগত, এবং কয়েক শতাব্দী পূর্বে তারা অভিবাসী হিসেবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সুতরাং তাদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে দাবি করা এক ধরনের ইতিহাস বিকৃতি এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচেষ্টা মাত্র।
অপরদিকে বাঙালি জনগোষ্ঠী বহু বছর ধরে বংশ পরম্পরায় এ অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। দেশের নাগরিক হিসেবে তারা লিজ প্রক্রিয়ায় রিজার্ভ জমিতে রিসোর্ট, হোটেল-মোটেলের ব্যবসা সহ নানা প্রকল্প চালু করছে,যা সরকারের রাজস্বসহ এ অঞ্চলের পর্যটন খাতকে উন্নত করছে। মূলত পাহাড়িদের সাথে বাঙালির দ্বন্দ্বের সূত্রপাত এখান থেকেই। নিজেদের ভূমিপুত্র দাবি করা পাহাড়িরা এ অঞ্চলে অন্য কাওকে অনুপ্রবেশ করতে দিতে রাজি না। এমনকি পর্যটন খাতের উন্নয়নও তাদের পছন্দ নয়।
এর সাথে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির দীর্ঘ সূত্রিতা পাহাড়ি ও বাঙালির সম্পর্কে সাপে-নেওলের অবস্থা তৈরি করেছে। দীর্ঘদিন ধরে একটি আন্তর্জাতিক মহল এ অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পাহাড়িদের ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। যেহেতু ভূ-রাজনীতির প্রশ্নে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সাথে বিষয়টি কনফ্লিকটেড, তাই তারা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অলিক স্বপ্ন দেখে যাচ্ছে। এটি দেশের মাথাব্যাথার অন্যতম কারণ।
পাহাড়ে একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পুরো অঞ্চলটাতে অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করেছে। কয়েকদিন আগে দেশে একটা অভ্যুত্থান হয়ে গেলো। নতুন সরকার এখনো দেশের আইন শৃঙ্খলা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনি। এরই মধ্যে পাহাড়ের এমন অবস্থা সত্যিই উদ্বেগজনক। সরকার চাচ্ছে রক্তপাতহীন সমাধান। পাহাড়ি নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলে এখনো কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। আমরা তাদের নৃশংসতার ইতিহাস জানি। তাদের হাতে নিহত বাঙালি ও সেনা সদস্যের সংখ্যা কম নয়। নিজ বন্ধুকে হত্যা করে তার মাংস রান্না করে খাওয়ার বর্বরোচিত ইতিহাস তাদেরই।
কাজেই দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো ছাড় নয়। আলোচনায় কাজ না হলে শান্তির জন্য কাওকে বাধ্য করা অন্যায় নয়। তবে রক্তপাতহীন সমাধান সবচেয়ে মঙ্গলের। কাজেই পাহাড় থেকে পুনর্বাসন করে তাদের সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হোক। এতে করে নির্দিষ্ট অঞ্চলে তারা যেমন কর্তৃত্ব হারাবে, তেমনি নিজেদের সংগঠিত রাখার ফুসরত পাবে না। এতেও কাজ না হলে দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে পূর্ণ শক্তি নিয়ে সেনা অভিযানের বিকল্প নেই।
লেখক: কবি ও কলামিস্ট