টাঙ্গাইল জেলায় ৫৮ বছরের মধুপুর লহরিয়া হরিণ প্রজননকেন্দ্রে দেখা মেলে মাত্র ৫-৬ টি চিত্রা হরিণের। প্রজননকেন্দ্রের কর্মকর্তারা বলছেন, ৭০ থেকে ৭৫টি হরিণ আছে। অন্যদিকে স্থানীয়রা বলছেন, সঠিক নজরদারি থাকলে এত বছরে হরিণের সংখ্যা দাঁড়ানোর কথা হাজারেরও বেশি।
জানা যায়, জেলার মধুপুরে ১৯৬৬ সালে জাতীয় উদ্যানে লহরিয়া হরিণ প্রজননকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। সাড়ে ২৭ একর জায়গায় দুই জোড়া প্রাপ্তবয়স্ক হরিণ নিয়ে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। অথচ প্রায় ৫৮ বছর পেরিয়ে গেলেও পাকা বেষ্টনী ঘেরা এই পরিসরে হরিণের দেখা মেলা যেন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উদ্যান দেখতে আসা দর্শনার্থী রনি জানান, এখানে হরিণ বাড়ে না কমে, সেটিই তো বোঝা দায়। এখানে হরিণগুলোকে সকাল-বিকেল দুবেলা খাবার দেওয়া হয়। তখন চার থেকে পাঁচটা হরিণ আসে খাবারের খেতে। যতবারই খাবার দেওয়া হয়, ততবারই ওই চার থেকে পাঁচটা হরিণ আসে। এতে কর্মকর্তারা বোঝায় ধাপে ধাপে হরিণ খাবারের জন্য আসে। যত ধাপেই আসুক না কেন ঘুরে ঘুরে ওই চার-পাঁচটাই আসে। এ ঘটনায় ‘হরিণ নিয়ে কুমিরের গল্প’ বোঝান কর্মকর্তারা। শেয়াল পণ্ডিতের কাছে কুমির তার চারটি বাচ্চা লালন-পালন করতে দেয়। এদিকে শেয়াল প্রতিদিন কুমিরের একটা করে বাচ্চা খেয়ে, শেষের বাচ্চাটাকে চারবার দেখিয়ে চারটি বাচ্চা সংরক্ষিত আছে বলে মা কুমিরকে বুঝিয়ে দেয়। ঠিক সেই গল্পের মতো কর্মকর্তারা এই উদ্যানে ৭০ থেকে ৭৫টি হরিণ আছে বলে বুঝিয়ে দেন।
রনি বলেন, মধুপুরে জাতীয় উদ্যানে হরিণ দেখতে এসেছি। এ প্রজননকেন্দ্রে দিন দিন হরিণ যেন হারিয়ে যাচ্ছে। ৫ বছর আগে দু-চারটি হরিণ দেখেছিলাম। এবারও এখানে হরিণকে খাবার দেওয়ার সময় খাবার প্রদানকারী একটি শব্দের মাধ্যমে হরিণদের বুঝিয়ে দেয় যে খাবার দেওয়া হয়েছে। তার ঠিক ১০ মিনিট পরই ছোট-বড় মিলে চারটি হরিণ খাবারের জন্য এলো। এই হলো হরিণ দেখা। এই চারটি এর আগেও দেখেছি। যতবারই খাবার দেবে এখানে চার থেকে পাঁচটি হরিণ আসে। এ ছাড়া ৫ বছর আগে এখানে অসংখ্য বানর দেখেছি। এখন সে বানরও যেন হারিয়ে যাচ্ছে। হরিণসহ পশুপাখি যত বেশি দেখা যাবে বনের শোভা ততই ভালো থাকবে। তিনি আরও বলেন, লহরিয়া প্রজননকেন্দ্রে যে কয়েকজন লোকবল আছে, আমার বিশ্বাস ততটি হরিণ আছে।
জাঙ্গালিয়া এলাকার বাসিন্দা মজিদ বলেন, লহরিয়া হরিণ প্রজননকেন্দ্রে ব্যাপকভাবে নজরদারি করা উচিত। এখানে হরিণে ভরে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে তুলনায় হরিণ বাড়ছে না। যেহেতু হরিণ দামি; তাই পাচার হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। মধুপুর বন এলাকায় মাঝেমধ্যেই দু-চারটি মায়া হরিণকে বনের আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। হরিণ সংরক্ষণের জন্য সরকার এখানে নির্দিষ্ট লোকবল দিয়েছে, অথচ সেখানে হরিণের দেখা মেলাই কষ্টকর। আমাদের বিশ্বাস অসাধু কর্মকর্তা ও শিকারিদের যোগসাজশে পাচার হচ্ছে হরিণ।
স্থানীয় বাসিন্দা নাছির ও লিটন বলেন, গাছাবাড়ি বিট এলাকায় যাতায়াতের সময় মাঝেমধ্যে মায়া হরিণগুলো দেখতে পাই। চার থেকে পাঁচটি হরিণ দলবেঁধে ছোটাছুটি করে। অনেক সময় শিকারিদের হামলায় গোয়াল ঘরে গিয়ে গরুর সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করে।
লিটন বলেন, কিছুদিন আগেও আমাদের বাড়িতে গরুর গোয়ালঘরে হরিণ এসেছিল। বনের ভেতর হরিণ, বনমোরগ ও বানরদের জন্য বিশেষ নজরদারি প্রয়োজন। খাবারের খোঁজে শত শত বানর রাস্তায় ছুটে আসে। একদিকে বনের ভেতর কোনো খাবার নেই, অন্যদিকে শিকারির হামলায় দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে বন্যপ্রাণী। লহরিয়া হরিণ প্রজননকেন্দ্রের মতো মধুপুর গড়ে বন্যপ্রাণীর জন্য খাবার তৈরি ও শিকারিদের হাত থেকে রক্ষার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
উদ্যানের বিষয়ে জানতে চাইলে লহরিয়া বিটের গার্ড আ. রহিম বলেন, এখানে আমরা চারজন দায়িত্বে নিয়োজিত আছি। আমি, মানিক, নজরুল ও বিট অফিসার মো. শাহ আলম খান। আমরা চারজন পালাক্রমে সুযোগ বুঝে হরিণদের সকাল-বিকেল দুবেলা খাবার দিয়ে থাকি। খাবারের মধ্যে রয়েছে খৈল, কুঁড়া, ভুসি ও লবণ। দুবেলা খাবারের আনুমানিক ১৫ থেকে ২০ কেজি দেওয়া হয়। এ ছাড়া এখানে বানরদের জন্য কোনো ধরনের খাবার দেওয়া হয় না। তবে আগে এখানে অনেক দর্শনার্থী আসত, তখন বিপুল সংখ্যক বানরও আসত খাবার খেতে।
লহরিয়া বিট কাম হরিণ প্রজননকেন্দ্রের কর্মকর্তা মো. শাহ আলম খান জানান, গত কয়েক মাস আগে গণনা করা হয়েছে ৮২টি হরিণ আছে। এরপর তার যোগদানের তারিখ জানতে চাইলে তিনি জানান, প্রায় এক বছর হলো। তখন তিনি ৭২টি হরিণ বুঝে নিয়েছিলেন।
টাঙ্গাইল জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, একটি হরিণ প্রতিদিন গড়ে ২ কেজি সবজি খায় এবং ২ লিটার পানি পান করে। খাবারের মধ্যে মিষ্টিকুমড়া, লাউশাক ও কলা বেশি পছন্দ করে। এ ছাড়া তাদের দানাদার খাবারের মধ্যে থাকে চালের কুঁড়া ও গমের ভুসি। তিনি মনে করেন সঠিক নজরদারি, নিরাপদ পরিবেশ ও সুষম খাদ্য নিশ্চিত করা গেলে দ্রুত বাড়বে হরিণের সংখ্যা।
টাঙ্গাইল বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক মো. আশিকুর রহমান জানান, মধুপুরে দুই জোড়া হরিণ নিয়ে যাত্রা শুরু। এরপর থেকেই অনেক কর্মকর্তা সেখানে পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করছেন। গত এক বছরে কোনো ধরনের হরিণ গণনা করা হয়নি। আসলে হরিণের সংখ্যা নিয়ে ইদানীং আলোচনা উঠছে; তাই আনুমানিক বলা হচ্ছে ৮২টি আছে। লহরিয়া হরিণ প্রজননকেন্দ্রে ধারণা করা যায়, ৩০ থেকে ৩৫টি নারী হরিণ রয়েছে। এগুলো প্রতি বছরে একটি করে বাচ্চা দিতে পারে। তিনি আরও জানান, চলতি বছরের ডিসেম্বরে গণনা দেব, তখন আসল সংখ্যা পেয়ে যাবেন। তিনি আরও জানান, বনের ভেতর বানরের খাবার ফুরিয়ে গেছে। যার কারণে বন থেকে বানর এখন লোকালয় যাচ্ছে। এগুলো রাস্তাঘাটে খাবারের সন্ধানে বসে থাকে।